ডাঃ সিঞ্চন দাস: সভ্যতা!! শতাব্দীর সবথেকে বড়ো মিথ্যা শব্দ বোধ হয় এই 'সভ্যতা' I এ কেমন সভ্যতা! যেখানে ক্ষমতাবান অহংকারে অন্ধ হয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ক্ষমতার আস্ফালন দেখিয়ে মৃত্যু মিছিল তৈরী করতে, যেখানে আকাশ- বাতাস বিষাক্ত হয়ে ওঠে ক্ষেপণাস্ত্রের বিষপাষ্পে, যেখানে আর্তনাদে পৃথিবী কেঁপে ওঠে! এ কি সভ্যতা নাকি সভ্যতার অভিশাপ ! ধিক্কার এমন সভ্যতাকে, যা অনৈতিক জীবনগাথা লেখে; ধিক্কার অমন সভ্যতাকে, যা ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ করে হত্যালীলা রচে; ধিক্কার অমন সমাজব্যবস্থাকে যা অব্যবস্থাকে সুব্যবস্থা বলতে শেখায়I
অভিনয় করতে করতে মানুষ এতটাই মশগুল হয়ে উঠেছে যে, নিজের নিজস্বতাকেই সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলেছে I বাহ্যিক চাকচিক্যে ও ভণিতায় এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, অভ্যন্তরীণ নগ্ন দৈন চরিত্রটা সেই চাকচিক্য চাপিয়ে বাইরে যে বেরিয়ে এসেছে, খেয়াল-ই করেনি I খেয়াল করবেই বা কি করে, অন্তরের আবৃত চেহারাটা-ই তো সে একেবারে ভুলে গেছেI দিবা-রাত্র সমগ্র সমাজ আজ ব্যস্ত, কেবলমাত্র নিত্য নতুন অন্তঃসারশূন্য যুক্তির সাহায্যে অযৌক্তিক দানবিকতাকে বা বলা ভালো বর্বরতাকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করতে I মানুষ আজ সত্যিই বদ্ধ উন্মাদ। বা বলা ভালো, উন্মাদ রোগে আক্রান্ত; অন্যের ক্ষতি করার নেশায় কখন যেন নিজের বসে থাকা ডালটাকেই কাটতে শুরু করেছে নিজের অজান্তেই, খেয়াল-ই করেনি I
সেই আদিকাল থেকে সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা বা যুদ্ধপ্রিয় মানসিকতা ডেকে এনেছে নানা অভিশাপ; সেই অভিশপ্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার নাম শক্তির আস্ফালন; এইসব ক্ষত আজও জ্বলজ্বল করছে পৃথিবীর বুকে I আজও রোগাক্রান্ত ও বিকলাঙ্গ শিশুগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সভ্যতার অভিশাপের ভয়াল চেহারা; কিন্তু এই অন্ধ ক্ষমতালোভী ব্যভিচারী সভ্যতার ধ্বজাধারীরাতো কবেই নিজেদের মন, মনন, বিবেক, মানবিকতা কিলোদরে বিক্রি করে দিয়ে এসেছে সুস্থতার নাম অসুস্থ করে তোলা ব্যবসায়ীদের কাছে I সর্বতোভাবে, দেউলিয়া মানুষ আজ কিভাবে বুঝবে এই সর্বনাশের পরিণতি কি হতে চলেছে !
আজ বড্ডো বেশি করে মনে পড়ছে, "রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়"- শীর্ষক প্রবাদটির কথা; রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার পড়েও যদি গণতন্ত্রের নেতৃবৃন্দের এহেন অবস্থা হয়, তবে তাঁরা নেতা তো অনেক পরের কথা, মনুষ্যপদবাচ্য কিনা ভেবে দেখার যথেষ্ট প্রয়োজন আছে I কখনো সন্তানসম্ভবা হাতিকে আতশবাজি খাইয়ে হত্যা, কখনো বা বাঘিনীকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে হত্যা, কখনো বা বিষ খাইয়ে শত শত কুকুর বিড়ালকে হত্যা, কখনো বা পৃথিবীর ফুসফুসকে ছাই করে ফেলে, কখনো বা ব্যবসার স্বার্থে মানুষকে গিনিপিগ বানিয়ে তোলা, কখনো বা ইরাক, কখনো বা জাপান, কখনো বা ইউক্রেইন; এগুলোকে কি সভ্যতার নিদর্শন বলে? নাকি, বর্বরতার নিদর্শন বলে ! কখনো সুদীপ্ত, কখনো মঈদুল, কখনো আনিসুর, কখনো বা ধর্ষণ, কখনো বা বৈরিতা, কখনো বা অনৈতিকতা, কখনো বা সমাজভীতি; না জানি এরকম আরো কত অসভ্য সভ্যতার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে আমাদের চারিদিকে ! এই প্রবণতাকে মানসিক বিকারগ্রস্থতা ছাড়া আর কি-ই বা বলা যেতে পারে ! তাই এই অসভ্য সভ্য কুশিক্ষায় শিক্ষিত বর্বর হিংসায় উন্মাদ অসুস্থ সমাজ তথা সময় কেবলই আজ করুণার পাত্র হয়ে উঠেছে।