স্মৃতি থেকে নেওয়া - BBP NEWS

Breaking

বুধবার, ১৯ জুলাই, ২০২৩

স্মৃতি থেকে নেওয়া




কলমে, সৈয়দ ইমতিয়াজ আহমদ

(দ্বিতীয় পর্ব)


ডাক টিকিট ও সরকারি ডাকটিকিটের পার্থক্য কি ?


প্রশ্নটার ধরনটাই আমার ঘাবড়িয়ে দিল, একটু ইতস্তত করতেই উনি, বেশ শ্লেষ সহকারে বললেন, ট্রেনিং-কলেজে শেখানো হয় কিভাবে সরকারি পয়সার ব্যবহার করতে হয় । চুপ থাকি । অতঃপর তার চুরির বিষয়ে বললেন, ওই তারকাটা কিভাবে হয়েছে ও আসামী পাকা না কাঁচা । ওসি কিছু বলার চেষ্টা করতেই, ধমক খেয়ে চুপ মেরে চলে গেলেন ।


 একটু থেমে বললাম তার দুভাবে কাটা যায়, হ্যাকশ অথবা কাটিং-প্লাসে, এটা হ্যাকশ বলে মনে হয় ও চোরেরা খুব পাকা নয় । প্রশ্নকর্তা আমার উত্তর শুনে কোনও কমেন্ট করলেন না, বললেন, মিসক্রিয়াশ্রটস্ মাষ্ট বি রাউন্ডেড আপ টু নাইট, বলে গটমট করে বেরিয়ে গেলেন, প্রত্যাভিবাদনের তোয়াক্কা না করেই।


কিছুক্ষণ পর সিআই সাহেব বললেন, প্রবেশনার ধৈর্য ধরে তদন্ত করে যেতে হয়, রেগে গেলে চলে না........ সুপিরিয়র হাজারটা কথা বললেও, বুঝলে কিছু-বলে স্যালুট রিটার্ন দিয়ে চলে গেলেন, আপন জিপে ।


এ, সা, বইঃ মন্ডল, আমি ও ওসি তার চেম্বারে আলোচনা করতে লাগলাম, কিভাবে সোর্স এনগেজ করে, তার চুরি কেসের ফয়সালা করা যায় ।


সোর্স ইনফর্মেশনে, ওইদিনই মধুপুরে, থানা থেকে দুই কিমি দূরে একটি কুঁড়ে ঘরে রেড করা হল, একজনকে ধরা হল, তার দুনস্বর বিবির কামরা থেকে, সে এতই নিশ্চিন্ত ছিল যে, বস্তা ভরা কাটা তার, হ্যাকশ ইত্যাদি নিয়ে, ঘুমোচ্ছিল, তার কাছ থেকে ওই মালামাল সিজ করা হল, উদ্ধারকৃত চোরাইমাল হিসেবে, সে একটু ধাক্‌কা খেয়েই স্বীকার করল, আগে তার চুরি করত, তাতে না-পোষানোয় ও নিকে করে মধুপুরে তার নতুন বিবির খরচ চালাবার জন্য, সহজ পন্থায় তার চুরি ধরেছে সম্প্রতি, তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনলাম, আগের রাত্রে, উদ্ধার করা মালামাল, ভাড়াকরা ঘোড়াগাড়িতে । 

ওসি ঘুমচোখে উঠে এলেন, জেরায় যা শুনলেন, তাতে মহাকুমা পুলিশ শাসকের কাছে আমার দেওয়া ব্যাখ্যার সঙ্গে মিলে গেল প্রায় টায় টায়। খুশি হলেন নিয়ম মাফিক তাকে ডাইরিতে হাজির করে মেসেজ পাঠালেন। সুপিরিয়রা এলেন, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন ও সব কথা জানলেন । আসামীকে পুলিশ কাস্টাডিতে রাখা হল লালবাগ কোর্ট থেকে আদেশ বলে, উদ্দেশ্য তার চুরির নেটওয়ার্কটা ধ্বংস করা। আসামীর বয়ান মতাবেক বিভিন্নস্থানে হানা দিয়ে চোরাই মাল ও আসামী উদ্ধার ও গ্রেপ্তার করে । যাতে ওইরূপ চুরিচামারি ওই থানা এলাকায় বন্ধ হয়ে যায় ।


কাজের প্রতি শ্রদ্ধা, কর্তব্যবোধের পরিচয় ও সেনস অব আরজেন্সী দেখালে, সব বিভাগের চরিত্রটাই পাল্টে যায়— সরকারি কাজ যে লাল ফিতের বাঁধনে হাঁস ফাঁস করে না, আঠারো মাসে বছর এইসব ধ্যান-ধারনা সেকেলে ও সাবেকি হয়ে দাঁড়ায় । কিন্তু থেকে যায় মনের মধ্যে নতুন জুতোর নেলের মত খচখচ করে বেঁধে পায়ের তলায় !


কদিন এই চাকরিতে আসার পর মনে হয়েছে, ধরা-বাঁধা জীবন, ছক কাটা মজা-খুশি লোটার অবকাশ নয় এ প্রবেশন পিরিয়ড, বরং ট্রেনিং-কলেজের চেয়ে এ জীবন তো সীমারেখার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার এক নিশ্চয়তা যা প্রতিপদে বিপদ, আশঙ্কা ও ভয়ভীতির আশঙ্কায় পরিপূর্ণ।


এ, সাব, ইঃ মন্ডলের সাথে একটা পলাতক ও ফেরারি আসামী ধরার ফাঁদ পেতে, মাঝরাতে ফেরার পর, ক্লান্ত হয়ে সবে ঘুমিয়ে পড়েছি, ভোররাতে ডিউটি অফিসার, খোলা জানালায় ডাক দিয়ে ঘুম ভাঙালেন, ধড়মড়িয়ে উঠলাম, ওসির আদেশ, ঝটপট রেডি হয়ে যেতে হবে, তার সঙ্গে ঘোড়া গাড়িতে, থানা থেকে মাইল পাঁচ-ছয় দূরে কুলগাছি গ্রামে যেখানে হিন্দু-মুসলিম উভয়পক্ষই আপন আপন এলাকায় সরস্বতী প্রতিমা বিসর্জনকে কেন্দ্র করে ঝামেলা করেছে । প্রথম পক্ষের বক্তব্য বরাবর ওই ভাবে, যায় মসজিদের পাশ দিয়ে, বাজনা বন্ধ করে, কিন্তু বিসর্জনের মিছিলের উপর দ্বিতীয় পক্ষ হামলা করে, প্রতিমার মঙ্গলহানি করেছে, অপরপক্ষের বক্তব্য, প্রথম পক্ষ মিছিল করে নিয়ে যাবার সময় খামোকা, মসজিদের টালি ভেঙেছে ও মর্যাদা হানি করেছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থের । শেষে শ্রুতিও মারপিট । দুপক্ষই কমবেশি জখম নিয়ে হাজির থানা প্রাঙ্গনে ভাঙা প্রতিমা ও টালি সহ হাজির । ওসি উভয়পক্ষকে থানার অফিসঘরে বসিয়ে, কড়া ডিউটি লাগিয়ে আমাকে ও ফোর্স সহ, ঘোড়াগাড়িতে করে অকুস্থল রওনা হলেন । ডিউটি অফিসারকে প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দিয়ে ।


সূর্য ওঠার আগে কুলগাছি এলাম, ভালো করে দেখলাম অকুস্থল, পথে যেতে যেতে ওসিকে বললাম, মনে হয় উভয়পক্ষের মধ্যে বিসর্জন মিছিল নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হওয়ায় যে কোনও ভাবে প্রতিমার মঙ্গলরানি ঘটলে, মুসলিমরা পিঠ বাঁচাবার জন্য মসজিদের টালি ভেঙে, কেস ফাঁদতে এসেছে, ওদের উভয়পক্ষকে, রওয়ানা হবার আগে, ভালো করে দেখে দুচার কথা বলে আমার এই ধারনা হয়েছে ।

ওসি গম্ভীর হয়ে বসেছিলেন। তার কথামত, ঘটনাস্থলের রাফ স্কেচ ম্যাপ তৈরি, টুকরো টালি সংগ্রহ করে সিজ করা লোকজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা বাদ করা এইসব সারতে লাগলাম, এলাকার উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মোটামুটি আধা কর্তাস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, চৌকিদার ও দফাদারকে জিজ্ঞাসা করে ওইরূপ ঘটনার পূর্ব ইতিহাস আছে কি না সমাজে খোঁজ নিতে লাগলাম, এমন সময় লালবাগ থেকে সিআই মিঃ ভট্টাচার্য ধুলো উড়িয়ে জিপে হাজির ছিলেন, ওসির সাথে একান্তে কিছু কথা বললেন, আমায় একটু পর ডেকে বললেন, প্রবেশনার, যারা অপরাধ করেছে, তাদের খুঁজে বের করে ধরার ব্যবস্থা করতে ও প্রয়োজনে ওই স্থানে ক্যাম্প করে থাকতে, ইত্যবসরে মহাকুমা পুলিশ শাসক এসে পড়ায় সমস্ত ঘটনা শুনে, ফর্মান জারি করলেন, এলাকায় ব্রেড রে মূল অপরাধীদের এ্যারেস্ট করতে, অবশ্য যারা অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ করেও গেছিল, তারা তো আমাদের হেপাজতে আছে, এফ আই আর ও কাউন্টার এফ আই আর করায় । সে কাজ তো আগেই সারা হয়ে গেছে ।


আরও পড়ুনঃ  ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ছয় ভারতীয় নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ


গোটা এলাকায় .. অপারেশন চালিয়ে, ধরার মত আর কাউকে না-পেয়ে বিকেলের দিকে হতাশ হয়ে ফিরলাম, যেখানে সুপিরিয়ররা ছিলেন, গ্রামীণ মফস্বল এলাকায় এত থাকি দেখার সৌভাগ্য সুযোগ গ্রামবাসীদের হয়ত এই প্রথম । আমার ধারনা ও গোপন তদন্তে তা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা বললাম, দেখলাম তারা মোটামুটি কনভিনসড ও আমার লজিকে স্যাটিসফায়েড ।


রাত্রিবাস করতে হল না, সারাটা দিন ড্রাইফুডের উপর চালিয়ে, চারটি ডাল-ভাতের জন্য মন তরসে ছিল, সেই আশায় গাড়িতে ফেরার পথে মোড়ে এক দারুন খবর পেলাম । জীবন অঘটন ঘটন পটীয়সী । চেনাজানা জীবনের ফাঁক-ফোকরে কত যে চমক, কত আশ্চর্য লুকিয়ে থাকে, কেজানে ? বিধাতা সবই জানেন বলে এত নীরব ও নিশ্চুপ কারণ তার মত জ্ঞাতা ও পরীক্ষকের জুড়ি মেলা ভার। থানায় ঢোকার মাইলটাক দূরের মোড়ে, সন্ধে সাত কি সাড়ে সাত, এ, সাব, ইঃ মন্ডল, তার মোটরবাইকে যেতে যেতে আমাদের মুখোমুখি হতেই থামলেন, ওদিকে কিসব কথা কানে কানে বললেন, ওসির নির্দেশে, তার মোটর বাইকে উঠে পড়লাম, খুব ঝটপট লালগোলা বাজারের এককোণে বাইক থামিয়ে দ্রুতগতিতে, মন্ডলের বলা মত একজনের বিবরণ পেয়ে, ধরার জন্যও চলতে লাগলাম ছদ্মবেশ ধারণ করে ।


একটি চায়ের দোকানে, চা খাবার জন্য গেলাম, গাড়িতে পোশাক বদলে, সাদা পোশাক পরে নিয়েছি ( যা মন্ডল আমার রুমের তালা মাস্টার কি দিয়ে খুলে, গার্ডের ব্যবস্থা করে, এনে দিয়েছেন) বিবরণ মিলে যাচ্ছে, এমন একজন হুমদো জোয়ান, চওড়া বুক, সবুজ লুঙ্গি, সাদা হাতগোটানো ফুলশার্ট, আমার ঠিক দুজনের পাশে, একই বেঞ্চের অপর প্রান্তে, চা খাবার তর সয় নি । হঠাৎ উঠে গিয়ে তার বুকের উপর রিভলবার ঠেকাতে, সেও উঠে পালাতে পায়ে পায়ে লাগিয়ে ফেলতেই, মন্ডল তার দুজন অনুচর সহ তাকে গ্রেপ্তার করে, লোকে আমায় চিনতো না, থানা অফিসার হিসেবে, আর সেই সুযোগটাই মন্ডল কাজে লাগাল, পরে আমার পরিচয় দিয়ে উত্তেজিত জনতাকে ঠান্ডা করে, এসেই ফেরারি আসামী ভৈরব শেখ যে গত ১৯৬৫ সালে, তার শশুরকে খুন করে, ফেরার হয়, গোদাগাড়ি এলাকায়, রাজশাহীতে, যতবারই তাকে ধরার জন্য ড্রাইভ দেওয়া হয়, সে ততবার হাওয়া হয়ে যায় । অবশেষে মন্ডলের পাতা ফাঁদে শিকার পাখি ধরা পড়ে । আমি আনন্দ ও উত্তেজনায় মুৎপিপাসা ভুলে গেছি, তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে, হাঁটিয়ে থানায় আনা হল । এলাকার লোক দেখে তাজ্জব বনে যায় কারণ ওকে ধরা তো স্বপ্নাতীত ব্যাপার ছিল। যাই হোক, থানায় এসে ওর বিরুদ্ধে লালকালির 'ফেরারি' মার্কা গ্রেপ্তারি পরওয়ানা, আমার নামে এনডর্স করিয়ে, ওটা জারি করার কাজ সারা হল। মন্ডলের ডিকটেশনে ভিডি দেখা হল। মেসেজে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সব কথা জানানো হল । পরদিন যথারীতি আসামীকে লালবাগ কোর্টে পাঠানো হল । বিকেলে জানতে পারলাম এসপি ভগবানগোলা থানা বার্ষিক পরিদর্শন সেরে, আমাদের থানায় এসে পরিদর্শন-কক্ষে রাত কাটাবেন। আমাদের ওসি, এ বিষয় খুব তৎপর ওই কক্ষে ঝাড়ুদার ডেকে সাফাসুতরো করাতে থাকলেন। শীতকাল বলে, স্থানীয় খেজুরগুড়, পাটালি হোমগার্ড পাঠিয়ে আনালেন, আর আনালেন খুশবু চাল, যা দিয়ে খুব সুস্বাদু পায়েস রান্না করা যায় আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, প্রবেশনার, চাকরি জীবনে, মনে রেখো কিপিং সুপিরিয়াস ইন গুড হিউমার ইজ এ্যান আর্ট— ইট রিটানর্স গুড ডিভিডেন্ডস..... 


আরও অনেক কথা বলেছিলেন জেলা পুলিশসুপার, একটু তাড়াতাড়ি কথা বললেন, ফলো করা মুশকিল, তাই আমায়, শিখিয়ে পড়িয়ে, পরদিন পুরো পোশাকে, তার কাছে, ওসি পুটআপ করলেন, এ প্রশ্ন, ও গল্প বলবার পর জানতে পারলেন, আমাদের এ্যাবস গ্রেপ্তার করার কথা, জিজ্ঞাসায় জানালাম ওই ফেরারি রেগুলেশনের ৩৭৬ বিধি মোতাবেক, পার্ট ওয়ান রেজিষ্টারভূক্ত, খুব খুশি হলেন, সঙ্গে সঙ্গে ইন্সপেকশন বুকে কমেন্ট করলেন প্রবেশনার ইজ এ্যাওয়ার্ডেড ওয়ান ওড সার্ভিস মার্ক......



 চলে গেলেন, ওসি আমায় সস্নেহে, আলিঙ্গন করে বললেন, আমার প্রবেশনার 'জিএস' মার্ক পেল, আমি গর্বিত, আমার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করে, আশীর্বাদ করতে লাগলেন । লালগোলা থানায় প্রবেশনার পিরিয়ড় ছিল হুমাস, কিন্তু মাস আড়াই তিনের মাথায় মহাকুমা পুলিশ অফিসার ওসি কে মেসেজ পাঠিয়ে লালবাগে ক্লোজ করলেন, উদ্দেশ্য সাদা পোশাকের পার্টির অর্থাৎ পি. সি পার্টির দায়িত্বে রেখে আমায় দিয়ে কিছু ফেরারি আসামী ধরানো যারা লালবাগ এলাকায় নকশালী তৎপরতায় পরিচিত ও কিছু খুন-জখমের জন্য ওয়ারেন্টি । 


অতঃপর বেডিংপত্র গুটিয়ে লালগোলা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে লালবাগ মহাকুমা শহরে। মহাকুমা পুলিস প্রশাসকের আদেশ পালন করতে, নিয়মমাফিক থানায় দুমাস থাকা আর হল না । মানিকচক এলাকা থেকে একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর আসায় ওসি, থানার বয়স্ক কনস্টেবল ভোলা সিং, ডোমসহ আমার ওই সে তদন্ত শুরু করতে বললেন ।


ঘটনাস্থলে সাধারণ মানুষ ঘিরে ছিল, এলাকার চৌকিদার, দফাদার সহ । আইনুদ্দিন সেখ, বয়স প্রায় পঞ্চাশ, কুষ্টরোগাক্রান্ত, আগে জমি-জিরেৎ ছিল । গ্রামের মাতব্বর ব্যক্তিরা আমায় সমাদর করে, আমগাছ তলায় বসালেন, কিন্তু সঙ্গী কং ভোলাসিং কোথায় ? একটু পরে দেখি ভোলাসিং, একটি লম্বা পাটকাঠি সহ হাজির, বললেন— স্যার আসুন, ঘটনাস্থলে, দেখি, কারণ এটাই প্রথম কেস, বেশ ঘাবড়ে গেছিলাম, আধবয়সি লোক পাগলা, মুখে সাদাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আধময়লা লুঙ্গি পরনে, ঊর্ধ্বাঙ্গে ছেঁড়াফাটা গেঞ্জি, উঠোনের একটা আমড়াগাছে, দড়ি গলায় মৃত অবস্থায় ঝুলছে । ভোলার কথামত ওই পাট কাঠির সাহায্যে ডালটার ও মৃতের পা দুটির মাটি থেকে উচ্চতা মাপা হল । তার মাথার চুল থেকে, ভোলার সাহায্যে, পায়ের নখ পর্যন্ত ভালোভাবে দেখলাম, নোটস্ নিলাম লাশ নামিয়ে, মাটিতে, ডোমের সহায়তায় তাঁর সারা শরীর, অঙ্গ-প্রতঙ্গ এমনকি গুহাদ্বার ও গোপন অঙ্গ ভালোভাবে দেখা হল। যদি কোনও কারণে এলিমেন্ট পাওয়া যায়, কিছুই পেলাম না, সুরত হাল রিপোর্টে, স্থানীয় সাক্ষীদের সই-সাবুদ নিয়ে, চালান নিয়ে লাশ পাঠালাম, ভোলার হেফাজতে লালবাগ পুলিশ মর্গে ।


দ্বিতীয় অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর এল, তুলনায় খানদানী ঘরের এক অবস্থা সম্পন্ন যুবতী বিধবার, ওসি, ব্যাপারটায় কোনও গোলমালের, আঁচ পেয়ে আমার নিয়ে সঙ্গে করে অকুস্থল রওনা হলেন, সাইকেলে শীতের মাঠ, রবিফসলে ভরা পোয়াতীর পেটের মত, সকালের রোদের ওম যেতে আমাদের স্বাগত জানাতে জানাতে চলেছে, আদিগন্ত, সবুজের বিস্তার, পদ্মার কোল ঘেঁষে, গ্রামের নাম দিয়াড় চললাম, পিছনে কনস্টেবল ও ডোম আসছে বেশ বর্ধিষ্ণু পরিবার, সচ্ছল, মৃতা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করায়, আপন শয়নকক্ষে, চিৎ হয়ে শায়িত, মৃতার নিকট আত্মীয়া সহ দু-তিনজন এসি, আমি ও ডোম দেখতে লাগলাম, লজ্জা-সংকোচ হচ্ছিল ওইরূপ ভরাট যুবতী শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ খুঁটিয়ে দেখার সময়, ওসির আদেশে সম্পূর্ণ নগ্ন করে টর্চ জ্বেলে তার গোপানাঙ্গ সহ সবকিছু ভালোভাবে দেখলাম, ডিসচার্জ হয়েছে, মোটামুটি দেখা হলে ওসি বললেন, দেখা হয়েছে তো ! আমি মাথা নেড়ে সায় দিলে, উনি আমার হাত ধরে তার ভরা বুক ভালকরে পরীক্ষা করতে বললেন, ভয়ে কী জানি কি হবে, হাত দিতে সংকোচ হচ্ছিল, ওসি দেখালেন, তার বাম নিপলের ভেতর একটা আলপিন । উনি বের করে সিজার লিষ্ট করলেন, অন্যান্য আলামত গ্রহণের সময় । নিয়ম মাফিক, লাশ পোষ্টমর্টেমের জন্য লালবাগ মর্গে পাঠানো হল, আর ওই আলপিন, পরবর্তীকালে, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হয় । আমি তখন লালবাগে, শুনেছিলাম, ওর মধ্যে প্রণয়ের ফলশ্রুতিতে তার নানা সহবাসের ফলে পেটে বাচ্চা আসায় ওই কুকীর্তি করেছে, তাকে মার্ডার কেসে গ্রেপ্তার করা হয় ও কোর্টে চালান দেওয়া হয় । ওই আলপিনে সেঁকো বিষের প্রমাণ মেলে।


পুলিশ নিয়মে ভাই প্রতিটি ইউ ডি কেস মার্ডার কেসের তদন্তের গুরুত্ব আরোপ করে, তদন্ত করা হয়। ওই ওসিই হাতেকলমে শেখালেন আমার ।

আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন ও প্রমোশনের জন্য যোগাযোগ করুন bbplive.news@gmail.com


জীবনে বাঁচতে গেলে, বৃহত্তর স্বার্থে আরও ভালো সেবক হতে গেলে, কেতাবী জ্ঞানের দুধ আর ব্যবহারিক বিধির মধুর সংমিশ্রণ বাঞ্ছনীয়, নইলে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায় । সেবা করার যোগ্যতা

অর্জন করা যায় না । সুদীর্ঘ কর্মজীবনে ওসির ওই উপদেশ আজও আমার মনের আয়নায় জ্বল জ্বল করছে, সাধ্যমত সেভাবে চলার চেষ্টায় নিরত আছি ।

মুর্শিদাবাদ থানায় তখন ওসি ছিলেন মিঃ বি. রায়, ডাইরেক্ট রিক্রট ৭০ সালে, সেই হিসেবে আমার চেয়ে সাত বছরের সিনিয়র, মাঝারি হাইট, সুস্বাস্থ্য, বেশ মর্যাদা সম্পন্ন চেহারা, এখন উনি ভুঁড়িদার প্রায় আধাবয়েসি, মালদা জেলার আসূচনা বিভাগের পরিদর্শক । মহাকুমা পুলিশ অফিসারের আদেশমত থানা প্রাঙ্গনে, এক এ, সাব, ইঃ হাকিম-এর বাসায় আমার স্থান করে দেওয়া হল, আমরা প্রায় ৬/৭ জন অফিসার ওইখানে থাকতাম, খেতাম থানার অদূরে এক সাধারণ হোটেলে । মধুর পাইস হোটেলে ।

কোনও সময়ক্ষণ নেই, হাবিলদার মারিকবাবু, তিনজন কনস্টেবল ও আমার নিয়ে গঠিত পিসি পার্টি, রেড করতে প্রত্যেকেই রিভলবার সহ, সাইকেল নিয়ে নাচ্চু বাবু, শ্রীকান্ত ইত্যাদি ডেঞ্জারাস নকশালীদের ধরার জন্য, মাঝরাতে কখনও ভোররাতে, কখনও মতিঝিলের পরিত্যক্ত বাড়িতে, কখনও সবজীখেতের মধ্যে ডিপটিউপ ওয়েল অপারেটারের বাসায় রেড করতে হয়েছে, ফিরতে হয়েছে খালি হাতে প্রায়ই । কারণ পাখি উড়ে গেছে !


বেশ কিছুদিন পর, এইভাবে ঘুরে ঘুরে ওদের কোনও হদিশ বের করতে না-পেরে, গোপন চর মারফৎ জানলাম, শহরের কিছু মান্যগণ্য * লোকের ছত্রছায়ায় ওরা বহাল তবিয়তে আছে, সংবাদটা মহাকুমা পুলিশ অফিসারকে জানাতে, উনি সব শুনে চুপ মেরে গেলেন, মুখে বললেন, রেড জারি রাখতে যাতে ওরা গোপন ডেরায় থাকতে পারে, প্রকাশ্য দিবালোকে যেন না আসতে পারে ।


 ( আগামী পর্বে..............)

Pages