স্মৃতি থেকে নেওয়া ( তৃতীয় পর্ব ) - BBP NEWS

Breaking

বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

স্মৃতি থেকে নেওয়া ( তৃতীয় পর্ব )

 


 সৈয়দ ইমতিয়াজ আহমদ 


বুকটা ধক্ করে উঠল, পড়িমরি করে, পিসিপার্টি 

সংগ্রহ করে হাসপাতালে ছুটলাম, ওসি. সি. আই, এসডিপিও পোশাক পরে ফোর্সসহ এলাকার নজরবন্দি করছেন, দারুন রেড চলছে, ওসি আমায় জখমি কালাচাদের কাছে রেখে ম্যাজিষ্টেট আনতে ছুটলেন, ডাইং ডিক্লারেশন রেকর্ড করার আশায়, জখমির হাল খুব গুরুতর হওয়ায় বললাম স্যার, ডাক্তার বাবু ও তো তা করতে পারেন ।


ওহ আই সি, প্লীজ মেক এ্যারেঞ্জমেন্ট বলে, অন্য একটা জরুরি খবর ফোনে পেয়ে, ছুটলেন ।


ডাক্তারবাবু ঝটপট তাকে ওটিতে নিয়ে গেলেন, আমরা বাইরে শুকনো মুখে, ঝামাঘষা নাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এভাবে লুকোচুরি খেলার একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক । কমলবাবু আমায় পাশে ডেকে চা খাওয়াতে খাওয়াতে, বললেন পরম আত্মীয়ের মত, স্যার এটা আমাদের চাকরি, খুন-জখম- রাহাজানি-চুরি-ডাকাতি চলতেই থাকবে, ক্রাইম না-হলে সমাজের উন্নতি হবে না, বরং ক্রাইম ও সমাজের প্রগতি, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, ঠিক যেন একটি পাখির দুটি ডানা, তাই চুরি-চামারি খুন চলতে থাকবে, আর আমরাও আসামী ধরার কাজ করতে থাকব । চাইব আরও ফোর্স, আরও গাড়ি, আরও গুলি বন্দুক, তাই স্যার, আপনার নতুন চাকরি সহজেই উত্তেজিত ও বিচলিত হয়ে যাচ্ছেন, মনে রাখবেন, আমরা খুব লেখাপড়া জানা লোক না-হলেও, অনেকদিন চাকরি করছি, এসব অভিজ্ঞতালদ্ধ জ্ঞান, কেতাবী জ্ঞান নয় ।


এখন ভাবি সংসারের বাস্তবতার চাইতে বড় কোনও বিশ্ববিদ্যালয় নেই, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ যেখানে সারা, সেখান থেকেই  সংসারের শিক্ষা শুরু, তাই আমাদের কেতাবী জ্ঞানের সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতার মেলবন্ধন অপরিহার্য, সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে । কালাচাদ খামকা, মার্ডার কেসের তদন্ত নিলেন, ওসি সন্ধেবেলা এসডিপিও সাহেব তার বাসায় তলব করলেন । লালবাগ এক ইতিহাস প্রসিদ্ধ মহাকুমা শহর, বাংলার নবাব আমলে ছিল রাজধানী, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শাসনকেন্দ্র এর ওলিগলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে নবাবী ঐতিহ্য, ইমারৎ, ঝিল, রাজপ্রাসাদ, যথা- হাজারদুয়ারী, ইমামবাড়া, নবাব প্যালেস, নমক-হারাম-কি দেউড়ি ভাগীরথির ওপারে খোশবাগ, যেখানে সিরাজের সমাধি এপারে হীরাঝিল মোতিঝিল ইত্যাদি সব মিলে, কবির ভাষায় যাহা দেখিতেছ তারে ঘিরে আছে, যাহা দেখিছ না তারই ভিড় ।


এসডিপিও মিঃ কুন্ডু ছিপছিপে চেহারা, রাগী রাগী ভাব, একটু- আধটু সাহিত্য-সংস্কৃতি ঘেঁষা, ওনার মেমসাহেবও পত্রিকায় লিখতেন অল্পস্বল্প । ডাইরেকট ডিএসপির চাকরিদের যুগের বেশি, অথচ পদোন্নতি হচ্ছে না । ভেতরে ভেতরে খিচিয়ে থাকতেন, কিন্তু মেলামেশা করলে ওনাকে....... ভেতরটা জানতে পারলে, ডি কোড করার বাড়তি সুবিধে পাওয়া যায় ।


এরূপ অফিসার আমায় কেন ডেকেছেন, ভাবতে থাকলাম, মনে মনে তৈরি হয়ে কেতাবী জ্ঞানটিই প্রিপেয়ার্ড ফর দি ওয়ার্স্ট হেপিং ফর দি বেষ্ট মাথায় রেখে সাইকেল নিয়ে রওনা হলাম, সময়টা আটাত্তরের জুনের গোড়ার দিকে ওনার অফিস-কাম-রেসিডেন্স, শহরের উত্তর পশ্চিম কোনে, ইমামবাড়ার উত্তর পার্শ্বে, প্রেস ব্রিফিং করেছিলেন, তাই রিডারের অফিসে অপেক্ষা করতে হল, সেইসময় লালবাগ মহাকুমা চুরি-চামারি-খুন ইত্যাদির জন্য স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় শিরোনামে ছিল, সরকারি জবানির প্রয়োজন ছিল উপযুক্ত প্রমাণে পুলিশ তৎপরতায় সঠিক ব্যাখ্যার তাই এই সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক । স্থানীয় ছাড়া সদরের রিপোর্টাররাও হাজির ছিল । তারমধ্যে আগে লালগোলায় স্বল্প পরিচিত পুনরায় দেখা, রঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হলে উইশ জানালাম, বিভিন্ন সংবাদ-সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সৌজন্য পরিচয়।



হল, পিসি পার্টি ইনচার্জ হিসাবে আমার কয়েকটা কথা, ঘরোয়াভাবে জানালাম, যা রিপোর্ট আকারে পরবর্তী সংখ্যায় বের হয় পত্রিকা প্রতিনিধির লেখনিতে ।


পত্রিকা প্রতিনিধিরা চলে গেলে, আমার ডাক পড়ল, অফিসঘরের মধ্যে যেখানে মহাকুমার বিভিন্ন থানার ওসিরা এসেছেন, লালগোলার সেকেন্ড অফিসারও ছিলেন, ওসি এক ডাকাতি কেস তদন্তে ব্যাস্ত থাকায়।


চেয়ারে বসলাম, চা-বিস্কুট এল, সাহেবের মেজাজ তুলনায় ভালো, একটু হাসিখুশি, না আঁচালে বিশ্বাস নাই, তাই সবিনয়ে পেশ করলাম আমাকে তলবের কারণ, উনি সংক্ষেপে যা বললেন, আসন্ন প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন উপলক্ষে উনি আমাকে গোটা সাবডিভিশনের গুলিবন্দুক, হোমগার্ড, এনভি এফদেরকে পোশাক-পরিচ্ছদ, লাঠি, হেলমেট ইত্যাদি সবকিছুর ভার দিতে চান । অনিল মুখার্জি সহ কয়েকজন হোমগার্ড ও ফোর্স নিয়ে ইমামবাড়ায় সব মালামাল দেখভাল, ইস্যু, রিসিভ করার দায় চাপাচ্ছেন। সায় দিলাম ওসি মুর্শিদাবাদ থানা একবার বললেন স্যার প্রবেশনারকে হয় গুলি বন্দুব অথবা পোশাক পরিচ্ছদের দায়িত্ব দেন, উনি আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, না সে দুটো দিকই সামলাবে ।


অগত্যা বেডিংপত্র নিয়ে ইমামবাড়ায় আসা ও ক্যাম্প করা হল। স্থানীয় হোটেলে খাওয়া-দাওয়া, ভাগীরথীতে রোজ দুবেলা স্নান, বিকেলে পাড় ধরে কিছুক্ষণ পায়চারি, সন্ধাবেলা হ্যারিকেন জ্বেলে রোজ নামতা লেখা ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠানোর কাজ চলতে থাকে । পরিচয় হল দলিল লেখক ফজলুল হকের সঙ্গে, উনি মুর্শিদাবাদ সাহিত্য সংস্থার সভাপতি, আমার কাছ থেকে, তাগিদ দিয়ে একটা কবিতা আদায় করলেন, মিঃ কুন্ডু, তার মেমসাহেব ও মহাকুমা বিচারবিভাগীয় হাকিম মিঃ পীযূষ মজুমদার লেখা দিলেন, এই সূত্রে কাছাকাছি চলে এসেছিলাম ।


নির্বাচন পর্ব ভালোভাবে চুকে গেল । পঞ্চায়েত নির্বাচন স্থানীয় স্বায়ত্ব শাসনের আইনি অধিকার প্রয়োগের পূর্বশর্ত গ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা আনবে পঞ্চায়েত শাসন, ছোটখাটো সমস্যার সমাধান করবে, উন্নয়ন পরিকল্পনা রাস্তাঘাট মেরামতি, নির্মাণ, বনসৃজন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ প্রকল্প এইসবের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে, বঙ্গ প্রদেশের সাবেক রাজধানীর বুকে বসে এই স্বপ্ন দেখতে থাকলাম গরমকাল, ইমামবাড়া পুরোনো ইমারৎ, তাই ভেতরটা বেশ ঠান্ডা ছিল, কিন্তু বিষাক্ত পোকামাকড় ইত্যাদির কামড়ে আমার পিঠে ঘা হয়েছে, কয়েকটা দগদগে। কিন্তু কর্তব্য কর্ম খুব সিনসিয়ারলি পালন করায় বিভিন্ন কর্ণার থেকে শুনতাম, সাহেব আমার কাজে খুশি ।


তাই সংশ্লিষ্ট অফিসার ও কর্মীদের রিওয়ার্ড রোল তৈরি করে, সাহেবের পরবর্তী আহ্বানে, বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে, তার বাসস্থানে নিয়ে যাই ।


দেখলাম অন্যান্য থানা অফিসাররা সাবডিভিশন থেকে এসেছেন, উনি আমাদের কর্তব্যবোধকে প্রশংসা করলেন, আমার রিওয়ার্ড রোলটার মানি রিওয়ার্ড সম্পাদনা করে দিলেন । কিন্তু সেটা যথাস্থানে গেল না, কারণ ওনার সিকিউরিটি ডিউটি কনস্টেবল নিতাই মাইতি, তার নাম ওই সুপারিশে না-থাকায় আমরা বেমালুম হাপিস করে দেয়। যথারীতি থানার ছ-মাস প্রবেশন পিরিয়ড শেষ হয়ে এল । আদেশ এল পরবর্তী ট্রেনিং, এর জন্য কান্দির সি. আই অফিসে রিপোর্ট করতে ।


বাক্স-প্যাঁটরা সহ কান্দি চলে গেলাম, যেখানে শুরু হল মাসব্যাপী শিক্ষনবিশী, সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত অফিসের কাজ ও বিকেলে থানা ভিজিট, সি আই সাহেবের গাড়িতে, পালা করে এ থানা থেকে অন্য থানা । কোনদিন খড়গ্রাম থানা, কখনও বড়োয়াঁ পি এস, কোনদিন বিকেলে ভরতপুর থানা আবার কখনও সালার বিট হাউস ।


মনে হচ্ছে, সি. আই সাহেবের নেতৃত্বে, একটা ডাকাতি হবার আগে খবর পেয়ে পুনাশী এলাকায় রাতভর রেড করতে হয়েছিল, তৎপরতায় দুজন কুখ্যাত ডাকাত ধরাও পড়েছিল, থানা অফিসাররা শুধু সেরেস্তা ওয়ার্ক করে পার পেতে পারেন না,সোর্স মেনটেন করতে হয়, আগে ভাগে ডাকাতি বা রাহাজানির খবরাখবর সংগ্রহ করতে হয় । কাজের জন্য ফোর্স অফিসারদের মোটিভেট করতে হয়, এ্যান্টি ক্রাইম ওয়ার্ক যে থানার যত বেশি হবে, তার এলাকা ততটাই ক্রাইম ফ্রিজোন হবে, এসব কাজ যতসহজে লেখা বা বলা হয়, ততটা সহজ সরল নয়, "বহুরকম বাধ্যবাধকতার মধ্যে এখানকার থানা অফিসারকে কাজ করতে হয়, বিশেষত আম-রাজনৈতিক সামাজিক, ধর্মীয় প্রেক্ষাপট চোখের সামনে রেখে, আর এ কাজে যত বাধা আসবে, অফিসারদের কাজের ধারাবাহিকতা ততই বিনষ্ট হবে, তারা হতোদ্যম হবে ও কাগুজে বাঘে পরিণত হবে ।


শিক্ষানবিশী কান্দি সি. আই অফিসে, একসময় শেষ হয়ে গেল, এবার হিসেবাত কোর্টে কাজ শিখতে যাবার কথা, কিন্তু অভাবনীয় বন্যা গোটা পরিস্থিতির ছবিটাই পাল্টে দেয় ।


আমরা তিন ব্যাচমেট, অরুণ, অমিতাভ ও আমি বহরমপুর পুলিশ অফিসার্স ক্লাবে আছি, এমন সময় মেসেজ এল লালগোলা এলাকায় ভীষণ বন্যা ওখানে অতিরিক্ত এস. পি মহাশয়ের কাছে রিপোর্ট করতে হবে ।


নতুন কর্মস্থল হল মৈয়াপন্ডিত পুর । এলাকার বিভিন্ন স্থানে শিবির স্থাপন করা হল, তখন কাজ শুধু ত্রাণ সামগ্রি পৌঁছাতে রাত জেগে বাঁধ বরাবর টহলদারী করা, বিপদের আশঙ্কা বুঝলে গ্রামবাসীদের সতর্ক করে দেওয়া ।


ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ ও ক্ষুদ্র সেচ বিভাগের মন্ত্রী, মুর্শিদাবাদের সুসন্তানকে অনুরোধ করেছিলাম, বাঁধ ব্যবস্থার যদি উন্নতি সাধনের জন্য কোনও দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প না হাতে নেওয়া হয়, তবে ফারাক্কা থেকে সুদূর জলঙ্গী, পদ্মানদীর পাড় বরাবর গোটা বিস্তৃর্ণ এলাকা ধ্বংস হয়ে যাবে । ভৌগোলিক অবস্থার মারাত্মক পরিবর্তন ঘটবে যাহা আমাদের কাছে অতীব ভয়াভহ ।


দেখলাম, সবাই যেন ত্রান সামগ্রী বিলি ব্যবস্থার উপর বেশি জোর দিয়ে চলেছেন, তাছাড়া আমার ওই সতর্কবাণী তো ছোটমুখে বড় কথা। অথচ আমি রোজ রাত্রে নামতায় তার সংক্ষিপ্ত বিবরণী লিখে রাখতাম । কারণ ওইসময় রাতজেগে টহলদারী অথবা লেখা একটা প্রিয় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে । জেলার সুপার মিঃ সিংহ আমাদের কাজকর্মে সন্তোষ প্রকাশ করলেন । আমরা পুরস্কৃত হলাম, বন্যার প্রকোপ কমতেই বহরমপুর ফিরলাম । ভাবলাম এবার একটু আনন্দ করব ব্যাচমেটরা। দ্বিতীয় দফায় বন্যাতঙ্ক মোকাবেলার জন্য মেসেজ এল মুভ টু কান্দি ।


প্রবাদবাক্য বলে ম্যান প্রপোজেস, গড় ডিসপোজেস । ভাবলাম নির্দোষ আনন্দ করব আমরা তিন ব্যাচমেট একটু ভাল-মন্দ খাওয়া- দাওয়া করে ছায়াছবি দেখে, দুম করে এস. পি-র মেসেজ এসে হাজির, অরুণ ও আমি মুভ টু কান্দি । আমি, অমিতাভ টু লালগোলা । আনন্দ সুখ মাঠে মারা গেল, ক্লান্তি কাটল না, আবার গোছগাছ, মোবাইল বেডিং নিয়ে রেডি হলাম পরদিন ভোরবেলা কান্দির জন্য ।


পথে পরদিন আসতে আসতে দেখলাম, প্রায় গোটা এলাকা জলময়, রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ার জন্য, লোকজন, কাঠখড়ি, বোঁচকা- কুঁচকি, মাথায়, পিঠে, ছোট বাচ্চাকে কাঁধে বা কাঁখে করে এলাকা ছেড়ে পঙ্গপালের মত পিল পিল করে পালাচ্ছে । পরাজিত সৈনিকের মত । সেসময় আমরা এন্টিক্রাইম কাজ-কর্ম শিকেয় তুলে দিয়ে যেভাবে পরিস্থিতির কারণে গণসেবার কাজে ডুবন্ত লোকজন উদ্ধারে, ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজে, নিজ নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছিলাম, তা প্রায় অনুপম ।


কান্দিতে ওসি মিহিরের কাছে রিপোর্ট পড়লাম। উনি আমাদের চেয়ে পাঁচ বছরের সিনিয়র । সি. আই সাহেবের সাথে অনেকটা মাছ বটির সম্পর্ক তার । আবার আমি ওই সি. আইয়ের প্রবেশনার কাম প্রিয়পাত্র ছিলাম, স্বাভাবিক কারণে আমার উপর বিরূপ ছিলেন, কোথায় থাকব বলায় খচে গেলেন । সকালে পৌঁছতেই চাল চিবানো গলায় বললেন গতকালই তোমাদের আসার কথা ছিল না ? এসেছ দেরী করে । বলেই একটা রাফ রুট চার্ট আনালেন । আমাদের দুই ব্যাচমেটকে সদর রাস্তা থেকে দোহালিয়া এলাকা পর্যন্ত রন্দগোছি করার আদেশ দিলেন। বেডিং-পত্র কোথায় রাখব জানি না ।


মুসকিল আসান করলেন, সেকেন্ড অফিসার জাফর সাহেব । হোমগার্ড দিয়ে তার বাসায় আমাদেরকে পাঠালেন, হাঁটু জল ভেঙে ছলাৎ ছলাৎ করতে করতে তার কোয়ার্টার্সে মালামাল রেখে ইউনিফর্ম পরে অরুণ আর আমি বেরিয়ে পড়লাম । হাঁটু ভরা কাদাজল ভেঙে রাস্তায় রাস্তায় ।


নৌকা চলছে, এদিক-ওদিক নির্দিষ্ট কোনও ডিউটি ছিল না । তাই আমরা সদর রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওদের খোঁজ-খবর নিতে থাকলাম । দোকানের চা-পাউরুটি খেয়ে, বিকেলে ওসি টহলদারিতে এলেন, পান চিবোতে চিবোতে আমাদের তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, কি খুব অসুবিধা হচ্ছে! ব্যাচমেট অরুণ একটা লেখার অযোগ্য খিস্তি ছুঁড়ে মারল নীরবে । বললাম সব ঠিক আছে, অন্য এলাকা ডুবে যাচ্ছে তা দেখার জন্য ওয়্যারলেস ফিটেট জিপ ছোটালেন, বেতো ঘোড়ার মত চলল লাফিয়ে লাফিয়ে। ভাঙাচোরা রাস্তায় ঘচাং ঘচাং ।


দুদিন দুরাত খাওয়া ঘুম বা বিশ্রাম ছিল না, তৃতীয় দিনে ডি. এম. মিঃ গুপ্ত, খুব মামলি পোশাকে আমাদের এলাকায় এলেন ।. আমাদের দেখে খোঁজ খবর নিলেন, বললেন আপনারা প্রবেশনার ? আমরা দুজন এটেনশন হলাম, সবিনয়ে উত্তর দিলাম ।


কাঁধে আলত চাপ দিয়ে বললেন, কাজের ফাকে ফাকে খাওয়া-দাওয়া করে নেবেন । এলাকার লোক আমাদের সততা কর্তব্যপরায়ণতার কথা তুলে ধরল। খুশি হলেন, স্যালুট রিটার্ন দিয়ে চলে গেলেন ।


চলে গেলে আমরা দুজন বলাবলি করতে লাগলাম । মানুষ যত উদার ও মানবিক হয়, তত বড় পদে তাকে মানায় । মনের তুলাদকে ওসি ও তাকে মাপলাম, কোনওভাবেই ওসিকে যিনি ক্ষমতায় ডি. এম-এর তুল্য, নিজ এলাকায়, মেলাতে পারলাম না ।


যার চায়ের দোকানে ছিলাম, সে জবাব দিলাম রসদ শেষ এবার ভাঁড়ারে টান, সে রাত্রি আমরা ঘনঘোর বর্ষায় অভুক্ত ছিলাম, বৃষ্টি এল ঝেপে, আকাশ কালো দৈত্যের মত, গজরাচ্ছে, আমরা থানায় ফিরলাম, কনস্টেবল ব্যারাকে বসে আছি । ওয়ারলেস মেসেজ এল ফায়ারিং ইন বেলডাঙ্গা ডেপুটি প্রবেশনার ইমিডিয়েটলি ওসি, ওই টি. এম আমার সিন করালেন, পরদিন আমাকে বেলডাঙ্গা থানায় রিপোর্ট করতে হবে ওসি বলরামবাবুর কাছে ।


ওসি কান্দি পি. এস. এবার আমায় জিপে, মালামাল সহ রণগ্রামের মোড় পর্যন্ত লিফ্‌টা দেওয়ালেন । সেখানে উঠলাম আধভাঙা নৌকায়, সঙ্গে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীরা, নৌকা তো জায়গায় জায়গায় ফুটো, অনেক কষ্টে তা চেপে চেপে ধরে আসছি । ঊর্ধ্বাঙ্গে ইউনিফর্ম নিম্নাঙ্গে আন্ডারওয়্যার ও গামছা, খালি পা, খড়ের উপর বসে আছি দেখি তার তলায় একটা বিষাক্ত সাপ, অন্য সময় হলে কি হত বলা সুকঠিন, এখন এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেও কেমন হিংসা ভুলে গেছে, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীরা তো তা দেখে এমন ভাবে হইহল্লা করে উঠল যে নৌকা ডুবে যাবার সামিল, ওরা আমার বারণ না-শুনে, নির্মম ভাবে ওই নিরীহ প্রাণীটাকে অ্যাসিড ঢেলে ঢেলে মারল যে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল ।


ঘণ্টা দুই জলপথে গিয়ে লোকালয়ের কাছাকাছি জায়গায় বাস পেলাম, তা ছাগল, মুরগি, ভেড়া-মানুষ আর তাদের নাদিতে ভর্তি । বমি আসতে লাগল, ভাগ্য ভাল পেট খালি তাই রক্ষে !


বহরমপুরে এসে, পথপাশের হোটেলে ডাল ভাত বেগুন ভাজা খেলাম বেশ কিছুদিন পরে, অমৃত, স্বর্গের উপাদেয় খাদ্যের চাইতে সুস্বাদু, কথায় আছে না যে হাংগার ইজ সি বেষ্ট স্য ? কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি ।


বহরমপুর পুলিশ লাইনস্ থেকে সরকারি গাড়িতে অন্যান্য ফোর্সের সাথে আমাকেও নিয়ে যাওয়া হল, ভাবতা পেরোবার পর দেখলাম জাতীয় সড়ক এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও কাটা যে তিন টগারের চালক আর এগোতে নারাজ । অগত্যা বোঁচকা-বুচকি সহ প্রায় আমরা যাযাবরের মত মাইল তিনেক পথ হেঁটে কভার করলাম । পায়ে তখন হাজা, ফসকা, মাথার চুল চিটচিটে, মুখে না-কাটা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মা-বাবা মরা ছেলের মত বেলডাঙা থানায় এলে ওসি মিঃ বি. রায় ডিউটি শোনালেন, বেলডাঙা রেল স্টেশনে ফায়ারিং হয়েছে, চলে যान ।


এই কয়েক সপ্তায়, পুরানো পুলিশদের সঙ্গে থেকে থেকে যেন বুড়ো হয়ে গেছি ! ওরা একতরফা হুকুম করে খালাস আর আমরা প্রবেশনার রা তা তামিল করতে বাধ্য । হাড় হিম করা পুলিশের কাজে এইভাবে প্রকৃতি আমাদের টিউনিং করার দায়িত্ব নিয়েছেন । অবস্থা বিপাকে, কেতাবী জ্ঞান নয় । সিনিয়রদের ব্যবহার অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছিল অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে যে আমরা প্রবেশনাররা জ্বলে-পুড়ে খাঁটি ইস্পাত হয়ে যাচ্ছিলাম । সুখ আরামের খোলসটা কোথায় যেন টান মেরে খুলে কোথায় ফেলে দিয়েছে কে জানে ?


বেলডাঙা রেল স্টেশনে দিন তিনেক কাটাবার পর কর্তাব্যক্তিদের স্মরণে এল আমার কথা, বিকেলবেলা ডি. এস. পি. সদর মিঃ বি. বি. দাশ এসে আমার খোঁজখবর নেন থানায় ফেরৎ নিয়ে যান, মেয়েলি সরু গলা ছিল তার, সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে, তার জিপে নিয়ে যেতে যেতে বললেন, কঠোরতায় কিছু হয় নি । ওরা যত কঠোর আদেশ শুনিয়েছে ততোধিক কঠিন হয়ে ডিউটি পালন করেছি, খাওয়া- নাওয়া বিশ্রামের কথা ভুলে গিয়ে বেমালুম চোখে জল এসে গেল । ছিঃ কাঁদে না, প্রবেশনার এই তো তোমার শুরু, তুমি যে ডিউটি ফুলনেশের পরিচয় রেখেছ তা ধরে রেখ, তোমার উত্তরোত্তর সাফল্য আসবে হাতের মুঠোয় ।


তিনি তাঁর গাড়িতে দিয়ে পাঠালেন ভাবতায়, হাজী সাহেবের ছেলেদের পাটের গোড়াউনের বিশ্রামাগারে। উদ্দেশ্য ফোর্স সহ জাতীয় সড়কে টহলদারী করা, নজর রাখা, ত্রাণের মালামাল যাতে নির্বিঘ্নে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যায় ।

Pages