সুরজিৎ দাস
সারা বিশ্ব জুড়েই চলছে লকডাউন ।গোটা পৃথিবী যেন এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত নেই গাড়ির হর্ণ; নেই কোনো ব্যস্ততা ,নেই কারখানার চিমনি থেকে নির্গত অনর্গল ধোঁয়ার রাশি। চারিদিকে যেন এক শান্ত নীরবতা ।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার নেই কোনো ব্যস্ততা। বলে রাখা ভালো আমার রুটিনের রদ বদল ঘটেছে প্রচুর। যেমন চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজ পড়া প্রায় নানা করে আমার বারো বছরের অভ্যাস, কিন্তু আজ আর নেই কারণ টা অবশ্য বলে রাখাই ভালো- খবরে কাগজ মানেই যেন এক মৃত্যু মিছিল, আর ভালো লাগে না।
তাই আজ-কাল খবরে কাগজ ছেড়ে হাতে এক গ্লাস চা নিয়ে বাড়ির সামনের বাগানের মত খানিকটা অংশ আছে সেখানে গিয়েই আরাম করি, এই ভাবেই আমার দিনের সূচনা হয়।
সেদিনও বাগানে কাজ করছিলাম আর প্রকৃতির অপূর্ব শোভা অনুভব করছিলাম। এমন সময় দেখি বাগানের ধারে কাঁটার বেড়ায় একটা ছোট্ট রাঙা মুনিয়া অপূর্ব ভঙ্গিতে একনাগারে ডেকে চলেছে। এরা আবাসিক পাখি। এতদিন এদের যেন আমরা ব্যস্ততার মধ্যে ভুলতে বসেছিলাম।
কয়েক পলক দেখতেই দেখি রাঙা মুনিয়া তার ত্রিকোণাকার লাল ঠোঁটে একটা ছোট্ট খড়ের টুকরো , দেখেই বুঝতে পারলাম এ-ডাক আসলে আমারই জন্য -এ নির্ঘাত বাসা তৈরীর করার ফন্দি-ফিকির করছে।
মনে মনে না হেসে পারলাম না। পাখিদেরও ভাষা আছে।এরাও কতো কথা বলতে চায় ভঙ্গির দ্বারা।
পাখিটা কয়েকবার এদিক ওদিকে দেখে বাগানেরই এক ঝোপের এবার এ-ডাল থেকে ও-ডাল ঘুরে উড়ে গেল আকাশের নীল সীমানায়।
সেদিনের মতোওখানেই শেষ। পরের দিন বাগান পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখি সেই রাঙা মুনিয়া পাখিটা, আজ সে একেবারে নীরব; যেন সে সকালের হালকা আলোর শোভা অনুভব করছে। এমন সময় কোথা থেকে উড়ে আর একটা রাঙা মুনিয়া পাখি এসে বসলো তারই পাশে।
অপূর্ব, তারা যেন একই রকমের শুধু পার্থক্য রঙের, এই যা। রাঙা মুনিয়া পুরুষ ও স্ত্রী সহজেই চেনার উপায় হল তাদের প্রজননের সময়, প্রজননের সময় পুরুষ মুনিয়ার উপরের পালক লাল রঙের হয়ে যায়; আর পেটের দিকটা সাদার ছিটে, যেন পালকের উপরে বুটিকের কাজ করা।
তাদের ডানায় হালকা রোদের আভা আর এক অপরের দিকে চাহনির বিচিত্র ভঙ্গি যেন বারবার প্রমাণ করে দিচ্ছে তাদের নব দাম্পত্য জীবনের কথা।
পুরুষ মুনিয়া এরই ফাঁকে উড়ে গিয়ে নিজের চাঞ্চল্যতা দেখিয়ে বারবার তাদের চঞ্চুর মিলন যেন প্রগাঢ় করে দিচ্ছে তাদের সেই প্রেমকে। অবাক লাগে যেন তারা নব প্রেমে মশগুল যুবক- যুবতী।
পরিহাস করে বললে হয় মুনিয়া আর মঙ্গলা'র প্রেম। কত অদ্ভুত কান্ড কাহিনি দেখতে দেখতে এক ঘন্টা অতিক্রম হয়ে গেল তা বুঝতে পারলাম না।
নিছক কৌতুহলের বশে বিকালের বাগানে গিয়ে আরো আশ্চর্য হয়ে যাই, একটি ঝোপের মধ্যে এর ই বাসা করে ফেলেছে। সত্যিই নব প্রেমিক-প্রেমিকারা এরকম কত রঙিন স্বপ্নই না দেখে । তাদের এই নবদম্পতির প্রেমে আমিও কখন কীভাবে যেন যুক্ত হয়ে পড়েছি তা বুঝতেই পারিনি।
এরা পরিযায়ী পাখি বছরে এক একবার সময় আসে আবার তারা কয়েকদিন পর এই খেলা ঘর ছেড়ে আবার চলে যায় অজানা, অচেনা দেশে। এবছর পরিবেশ পরিষ্কার থাকায় এদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদের দেখে দেখে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায়, বড়ো আশ্চর্য লাগে এদের অনুভূতি যেন ঠিক মানুষের ই মতো।
সেদিন দেখি এক আশ্চর্য ব্যাপার, দুটো মুনিয়ার সঙ্গে আর একটি মুনিয়া কোথা থেকে যেন এসে যোগ দিয়েছে। এটি তাদের চেয়ে সাইজে ছোট, আর এটিকেও যেন সময় দিচ্ছে একটু একটু করে মঙ্গলা। মুনিয়া লেজের আগা কয়েকবার ঝাপট মেরে আকাশের বুকে তার সুন্দর ডানা মেলে উড়ে গেল। মুনিয়া এক তীব্র চিৎকার করে উঠল। তবে কি এ-মঙ্গলার প্রতি তীব্র ভৎসনা! তবে কী তাদের প্রেমে ত্রিকোন সমস্যা?
মঙ্গলা কিছুক্ষণের মধ্যেই চুপ করে গেল। তাদেরই কয়েকদিনের সুখী দাম্পত্য জীবনের হঠাৎ যেন নিরস হয়ে গেল কই আগের মতো আর মঙ্গলা তো গান করে না। মুনিয়াকে খুশি করার জন্য তাদের চঞ্চুতে চঞ্চুতে মিলনই বা কোথায়?
বড় রাগ হল মঙ্গলার প্রতি, বড় স্বার্থপর। কী দরকার ছিল রাঙা মুনিয়াকে ছাড়ার। এই মুনিয়া থেকে রাঙা মুনিয়া তো বেশ সুন্দর দেখতে- চোখের নীচে হালকা সাদা রেখা, মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত বিচিত্র পালক পেটের দিকে চকচকে পালকের উপর সাদা সাদা ফুটকি দাগ। আর সেইসঙ্গে গোলাপি পা দুটি যেন প্রকৃতি শিল্পী যত্ন করে এঁকে দিয়েছেন।
কয়েক মুহূর্তে পরিবেশটা যেন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল পশ্চিম দিকের পড়ন্ত সূর্যের রোদে সমগ্র আকাশ যেন বিচিত্র রঙে সেজে উঠেছে ।
বাড়ির ব্যালকনি থেকে প্রকৃতির আঁকা ছবি দেখতে দেখতে এক সময় ঘন ধূসর মেঘ এসে পশ্চিমের আকাশ ছেয়ে ফেলল । তখনও রাঙা মুনিয়া বাসার বাইরে । সন্ধ্যা হতে না হতেই সারা আকাশ ছেয়ে গেল সেই মেঘে। বাতাসের একদমকা বাতাসে সমগ্র রাজ্যকে যেন তোলপার করে দিল। সেই সঙ্গে শুরু গেল বজ্রপাতের সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি ।বৃষ্টি কখন ছেড়েছে জানিনা, হয়তো সারা রাতই বৃষ্টি হয়েছে। শুতে যাওয়ার আগে টর্চের আলোয় নবদাম্পত্তির মানভঞ্জন হল কিনা দেখার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু বৃথা।
পরদিন সকালে যখন উঠলাম, তখন বাইরে ঝড় থেমে গেছে; পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা গেল।
বাইরে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতেই বাগানের দৃশ্য যা দেখলাম তা ভয়াবহ। বাগানের সব গাছপালা কে যেন থেঁতলে দিয়ে গেছে,চারিদিকে থই থই করছে জল , তারই মাঝে দেখি রাঙা মুনিয়ার বাসা জলে ভেসেছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি রাঙা মুনিয়া আর মঙ্গলা সেই নবাগত মুনিয়াকে ঘিরে বসে রয়েছে। এই অকৃত্রিম ভালোবাসা আর যেন কোথাও নেই।
