বিবিপি নিউজ,রাজকুমার দাস: পেশায় তিনি একজন পান বিক্রেতা। বেহালার মদনমোহন তলা বাজারে গেলে দেখা মিলবে ফুটপাতের ধারে ছোট্ট একটি দোকানে বসে এক জন হয় লিখছেন, না হয় পড়ছেন। দোকান, চেহারা আর পোশাক-আশাক দেখলেই তাঁকে অতি সাধারণ এক জন মানুষ বলেই মনে হবে। কিন্তু তাঁর নাম শুনলে আপনি নিশ্চয়ই চমকে উঠবেন। তাঁর লেখা গল্প-কবিতা আনন্দবাজার পত্রিকা, আনন্দমেলা, সানন্দা, দেশ, নবকল্লোল, শুকতারা, বর্তমান, প্রতিদিন, সাপ্তাহিক বর্তমান, শিলাদিত্য, কৃত্তিবাসের মত বাংলা প্রথম সারির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আপনারা পড়েছেন। ইতিমধ্যেই তাঁর ছোটদের জন্য লেখা পাঁচটি গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি হলেন পিন্টু পোহান।
একসময় পরিবারের হাল ধরতেই নিজের পড়াশোনার ইতি টানেন। সময়টা ১৯৯৮। কলকাতার পথে পথে এক মেধাবী ছাত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে চাকরির সন্ধানে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে
ভর্তি হয়েছিল সে। আর্থিক কারণে কলেজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। পরিচিত-অপরিচিত অনেক মানুষের কাছে যাচ্ছে সে। না, কেউ তাকে খেয়েপরে বাঁচার মতো একটা চাকরি বা কাজ কিছুই দিতে পারছে না। এভাবে কতদিন শুধু একটা কাজের জন্য ঘুরে বেড়ানো যায়! শেষে সে সিদ্ধান্ত নিল বাড়ির কাছে বাজারে একটা পান-বিড়ি-সিগারেটের ছোট্ট দোকান দেবে। কয়েক জন বন্ধুর সহায়তায় খুলে ফেলল দোকান। দোকান চলতে শুরু করল। তার ভাত-কাপড়ের সমস্যা মিটল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়। ছোটবেলা থেকেই তার পড়া আর লেখার নেশা। দিনে চৌদ্দ-পনেরো ঘন্টা দোকান চালাতে গিয়ে পড়া-লেখা কিছুই হচ্ছে না।
এখন আবার পড়া-লেখা শুরু করতে গেলে দোকানটা বন্ধ রাখতে হয়। আর দোকান বন্ধ রাখলে তার ও তার পরিবারের ভাত-কাপড় সবই যে বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক ভেবেই সে সিদ্ধান্ত নিল দোকানে বসেই লিখবে আর পড়বে। শুরু হল তার অসম্ভবকে সম্ভব করার এক অসম লড়াই। হাতে তুলে নিল বই আর কাগজ-কলম। খদ্দের এলে বইখাতা কোল থেকে নামিয়ে রেখে খদ্দেরের চাহিদা মেটায়। খদ্দের চলে গেলেই আবার কোলে তুলে নেয় বইখাতা।
তাঁর লেখা, পারুলমাসির ছাগলছানা, নোটন নোটন পায়রাগুলি, ইলিশখেকো ভূত, কচুরিপানার ভেলা ও ঝিনুককুমার। যা উচ্চ প্রশংসিত সাহিত্যের গুণগত মানের বিচারে। হ্যাঁ, আজও ফুটপাতের একটা ছোট্ট দোকানে রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে দোকানদারির পাশাপাশি মানুষের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ উপেক্ষা করে সাহিত্য সাধনা করে চলেছেন পিন্টু পোহান। প্রতিটি পেশার মানুষের সম্পর্কে আমাদের সমাজের গতে বাঁধা কিছু ধারণা আছে। একশো শতাংশ না হলেও নিরানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে তা মিলে যায় বলে গতে বাঁধা দৃশ্যের বাইরে কিছু দেখলেই তা আমাদের চোখে দৃষ্টিকটু মনে হয়। আমরা তাকে একেক জন একেকটা নামে অভিহিত করি। কেউ পাগলামো বলি। কেউ বলি লোক হাসানো। ফুটপাতের ছোট্ট দোকানে বসে ছেলেটাকে শুধু লিখতে-পড়তেই তো দেখল না সকলে! দেখল, কয়েক জন বন্ধুকে জুটিয়ে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে। এই দোকানে বসে পড়েই সে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক হল। এই দোকানে বসে পড়েই সে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার ডিগ্রিও অর্জন করল। তবুও তার লড়াই সবারই যেন চোখ এড়িয়ে গেল। পাশে পেল না সে কোনও সুহৃদ। পেল শুধু অবজ্ঞা আর অবহেলা।
না, সে তাতেও দমল না। দোকানের সামান্য রোজগারকে সম্বল করেই সে চালিয়ে চলেছে তার লক্ষ্যে পৌঁছনোর লড়াই। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ। শুধু একটাই আবেদন যদি কোনো সাহিত্য সংগঠন কিংবা সরকারী প্রতিষ্ঠান পিন্টু র কাছে আর্থিক সাহায্য মাধ্যমে এগিয়ে আসে তাহলে সাহিত্য সৃষ্টির এক নতুন স্টার কে আমরা খুঁজে পাবো।